কান্তজীর মন্দির কোথায় অবস্থিত এবং কেন বিখ্যাত

 সকালে রসুন খাওয়া শরীরের জন্য ভালো

বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত দিনাজপুর জেলার একটি নিভৃত গ্রামে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ স্থাপত্যকীর্তি-কান্তজীর মন্দির। এই মন্দিরটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং এটি বাংলার প্রাচীন টেরাকোটা শিল্পের সর্বোচ্চ নিদর্শন হিসেবে বিখ্যাত।

প্রতিবছর হাজার হাজার দর্শনার্থী এবং তীর্থযাত্রী এখানে আসেন এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে এবং ইতিহাসের সাক্ষী হতে। আজ আমরা এই পোস্টে বিস্তারিত আলোচনা করব কান্তজির মন্দিরের অবস্থান, ইতিহাস,স্থাপত্যশৈলী,কী কী অপরূপ উপাদান এটিকে অতূলনীয় করে তুলেছে এবং এর বিখ্যাত হওয়ার কারণগুলো নিয়ে।

পোস্ট সূচীপত্রঃ কান্তজির মন্দির কোথায় অবস্থিত

  • এক রাজবংশের ভক্তি ও উত্তরাধিকার
  • নবরত্ন থেকে টেরাকোটা মাস্টার পিস
  • মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গঠন ও দেবমূর্তি
  • টেরাকোটা ফলকে সমাজ জীবনের চিত্রণ
  • উৎসব ও রাস মেলা
  • পর্যটন ও ভ্রমণ তথ্য
  • শিল্পী ও কারিগরদের ভূমিকা
  • শেষ কথা

কান্তজির মন্দির কোথায় অবস্থিত

দিনাজপুরের কান্তনগরে অবস্থিত এই মন্দিরটি। শতাব্দী পেরিয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক, তীর্থযাত্রী এবং শিল্পানুরাগী এখানে আসেন- কেউ দেব দর্শনে, কেউ টেরাকোটা ফলকের অপরূপ নৈপুণ্য দেখতে, আবার কেউ বাংলার গৌরবময় অতীতের স্পর্শ অনুভব করতে।কান্তজির মন্দির, যাকে কান্তজিউ মন্দির বা কান্তনগর মন্দির নামেও ডাকা হয়, বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার কাহারোল উপজেলায় অবস্থিত।

 নির্দিষ্ট ভাবে বলতে গেলে, এটি কান্তনগর গ্রা্মে, দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ২০- ২১ কিলোমিটার উত্তরে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত। দিনাজপুর তেতুলিয়া মহাসড়ক থেকে মাত্র এক-দেড় কিলোমিটার পশ্চিমে এই মন্দির চারপাশে সবুজ ধান খেত নদীর শান্ত প্রবাহ এবং গ্রামীণ পরিবেশ এখানে এক অপরূপ শান্তি প্রদান করে। ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেনে দিনাজপুরের সেই স্থানীয় অটো রিক্সা বা সিএনজি দিয়ে সহজেই পৌঁছানো যায়।

এই মন্দির শুধু ধর্মীয় স্থান নয়, এটি একটি জীবন্ত জাদুঘর, যেখানে দেয়ালের প্রতিটি ইঞ্চি কথা বলে ১৮ শতাব্দীর বাংলা সংস্কৃতি,সমাজ এবং শিল্পের কথা।প্রতিটি দেয়ালে রোয়েছে অতুলনীয় দৃশ্য,যা অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর। এই নিভৃত অবস্থানই মন্দিরটিকে আরও রহস্যময় এবং আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

 এক রাজবংশের ভক্তি ও উত্তরাধিকার

কান্তজীর মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে দিনাজপুরের জমিদার মহারাজা প্রাণনাথের পৃষ্ঠপোষকতায়। প্রাণনাথ একজন কট্টর কৃষ্ণভক্ত ছিলেন। জনশ্রুতি আছে, তিনি বৃন্দাবন থেকে কৃষ্ণের (কান্তজী) মূর্তি এনে প্রথমে অস্থায়ী স্থানে রাখেন এবংপরে একটি গ্র্যান্ড মন্দির নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তার মৃত্যুর পর তার দত্তক পুত্র রামনাথ ১৭২২- ১৭৫২ সালের মধ্যে নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করেন। মন্দিরটি কৃষ্ণ এবং তার সঙ্গিনী  রুক্মিণীকে  উৎসর্গ করা।

নির্মানে পারস্য থেকে শিল্পী আনা হয়েছিল বলে কথিত আছে এবং স্থানীয় মিস্ত্রীরা নয়াবাদ গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মন্দিরের নয়টি চূড়া (নবরত্ন) ধ্বংস হয়ে যায়, যা এর মূল সৌন্দর্যের একটি বড় অংশ ছিল। পরবর্তীতে ২০শ শতাব্দীর শুরুতে দিনাজপুরের মহারাজা গিরি জামাত বাহাদুর মন্দিরের মূল কাঠামো ও টেরাকোটা অলংকরণ সংস্কার করা হয় এবং ১৯৬০ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে সংরক্ষিত ঘোষণা করে রক্ষণাবেক্ষণ করছে। এটি বাংলাদেশের জাতীয় ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

২০১৭ আলের কলকাতা বইমেলায় বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশীল নিদর্শন হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাদের প্যাভিলিয়নটিকান্তজির মন্দিরের আদলে গড়েন।২০২৪সালের ২৭এপ্রিল ২০ হাজারের বেশি মানুষের কন্ঠে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাট অনুষ্ঠিত হয়।বর্তমানে(২০২৫সাল পর্যন্ত) মন্দিরের টেরাকোটা ফলক গুলোর ক্ষয় রোধে বিশেষ যত্ন নেয়া হচ্ছে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ টাকার নোটে কান্তজিউ মন্দিরের ছবি যুক্ত করে।

 নবরত্ন থেকে টেরাকোটা মাস্টার পিস

কান্তজির মন্দির মূলত নবরত্ন শ শৈলির (নয়টি চূড়াযুক্ত) একটি উদাহরণ ছিল,যা বাংলার মন্দির স্থাপত্যের স্বাক্ষর। তিন তলা বিশিষ্ট এই মন্দিরটি বর্গাকার ভিত্তির উপর নির্মিত, প্রায় ৫০ ফুট উচু। চারদিকে খিলান যুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে, যাতে যে কোনদিক থেকে দেবমূর্তি দর্শন করা যায়। কিন্তু এ্রর প্রধান আকর্ষণ হল টেরাকোটা অলঙ্করণ। মন্দিরের প্রায় প্রতি ইঞ্চি দেয়াল পোড়ামাটির ফলক দিয়ে ঢাকা- অনুমান করা হয় প্রায় ১৫০০০ ফলক ব্যবহার করা হয়েছে।

এই ফলকগুলোতে রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণ লীলা, রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা, ফুলের নকশা, জ্যামিতিক প্যাটার্ন্,সমসাময়িক সমাজজীবন, শিকার দৃশ্য, নৌকা যুদ্ধ,মুঘল অভিজাতদের শোভাযাত্রা ইত্যাদি চিত্রিত। উল্লেখ্য, অন্যান্য মন্দিরের মতো এখানে কামুক দৃশ্যের চিত্র নে্‌ই, যা এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। টেরাকোটা ফলকগুলো এতটাই জীবন্ত যে, দেখলে মনে হয় যেন একটি চলমান কাহিনীচিত্র।

মন্দিরের পশ্চিম দিকের দ্বিতীয় বারান্দা থেকে সিঁড়ি ওপরের দিকে উঠে গেছে। মন্দিরের নিচ তলায় ২১টি এবং দ্বিতীয় তলা ২৭টি দরজা-খিলান রয়েছে, তবে তৃতীয় তলা রয়েছে মাত্র ৩টি করে। এটি বাংলার পলিমাটির উর্বরতা এবং শিল্পীদের দক্ষতার প্রমণ দেখিয়েছে তারা তাদের কাজের মাধ্যমে।

মন্দিরের অভ্যন্তরীণ গঠন ও দেব মূর্তি

কান্তজির মন্দিরের ভিতরে একটি ছোট, অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্ভগৃহ রয়েছে, যেখানে মূলত দেবতা রাধা-কৃষ্ণের মূর্তি স্থাপিত। এটি সাধারনত বর্গাকার এবং সরল- দেয়ালে টেরাকোটা অলঙ্করণ আছে, কিন্তু বাইরের মতো বিস্তৃত নয়। মূর্তিগুলো কালো বসাল্ট পাথরের তৈরি এবং অত্যন্ত সুন্দর কারুকাজযুক্ত। গর্ভগৃহের চারপাশে খিলানযুক্ত করিডর রয়েছে, যা ভক্তদের চারদিক থেকে দর্শন করার সুবিধা দেয়। কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে বলা হয় মূলত সোনার বা মূল্যবান মূর্তিগুলো চুরি হয়ে গেছে।

 সেখানে প্রতিস্থাপিত মূর্তি বা প্রতিকি বিগ্রহ রয়েছে, যা পূজা চলছে। প্রতি বছর রাস উৎসবের সময় মূর্তিকে রাসমঞ্চে নিয়ে যাওয়া হয়। অভ্যন্তরের মূর্তি দর্শের জন্য সাধারণত পুজারিদের সাহায্য নিতে হয় এবং ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ হতে পারে। অভ্যন্তরীণ দেয়ালেও কিছু টেরাকোটা অলঙ্করণ  আছে, যদিও বাইরের তুলনায় কম। মন্দিরের ভিতরের পরিবেশ শান্ত এবং নিরিবিলি, যা ভক্তি ও ধ্যানের জন্য উপযুক্ত। যদি সরাসরি ভ্রমণ করেন, তাহলে পূজার সময় গেলে দেবমূর্তি দর্শনের সুযোগ পাবেন।

টেরাকোটা ফলকে সমাজ জীবনের চিত্রণ

মন্দিরের দেয়ালে টেরাকোটা ফলকগুলোতে ১৮শ শতাব্দীর বাংলার দৈনন্দিন জীবন অত্যন্ত জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। এখানে দেখা যায় নৌকায় যাত্রা, শিকারের দৃশ্য, অভিজাতদের আমোদ- প্রমোদ, হাতি- ঘোড়ার যুদ্ধ, বাজারের দৃশ্য, নারী-পুরুষের দৈনিক কাজকর্ম ইত্যাদি। এছাড়া ইউরোপীয় জাহাজ,পুর্তগিজ বণিকদের চিত্রও রয়েছে, যা সেইসময়ের বাণিজ্যিক যোগাযোগের সাক্ষ্য বহন করে। এই চিত্রগুলো ঐতিহাসিক দলিলের মতো কাজ করে, যা বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের একটি দুর্লভ রেকর্ড।

টেরাকোটা ফলক গুলো তিনটি স্তরে বিভক্ত-নিচের সারিতে ফুল-পাতার নকশা, মাঝের সারিতে,  মূঘল অভিজাতের জীবন(শিকার,শোভাযাত্রা,মুঘল পোশাক-অস্ত্র)এবং উপরের সারিতে পৌরাণিক কাহিনী রামায়ণ ও মহাভারতের পূর্ণাঙ্গ দৃশ্য কৃষ্ণ লীলা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ইত্যাদি এই মুঘল প্রভাব তৎকালীন বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক মিশ্রনের প্রতিফলন। 

এটি চারদিকের দেয়াল জুড়ে সমান্তরাল ভাবে চলেছে। জমিদারদের নেতৃত্বে বন্যপ্রাণী স্বীকার, হাতি- ঘোড়ায় চড়ে শিকারি দল, তীর- ধনুক বা মাস্কেট নিয়ে শিকার।উটের লাইন, সুসজ্জিত রথ বা গাড়ি পোষাক পরা সৈন্য বা অনুচর।জমিদারের বিলাসিতা ছিল- পালকিতে বসে হুক্কা টানা মোটা জমিদার,তাদের অনুচরবৃন্দ।

আর যুদ্ধের দৃশ্য-(কুরুক্ষেত্র বা লঙ্কা যুদ্ধের সাথে মিশ্রিত সমকালীন যুদ্ধ) নাচ-গানের দল, ফুলের সীমানায় ঘেরা দৃশ্য। এই চিত্রগুলোতে মুঘল প্রভাব স্পষ্ট( পোষাক, অস্ত্র,শোভাযাত্রা) তৎকালীন বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতিফলন। শিল্পীরা(প্রধানত কৃষ্ণনগরের লোকশিল্পী) তাদের পরিবেশের সাথে দেবতাদেরও মিশিয়ে দিয়েছেন, যাতে সমাজ জীবন আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে।

উৎসব ও রাস মেলা

কান্তজির মন্দির বাংলাদেশের হিন্দুর সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান উপাসনাস্থল। কান্তজির মন্দিরের সাথে জড়িত সবচেয়ে বড় ও ঐতিহ্যবাহী উৎসব হলো রাস উৎসব বা রাস মেলা। এটি শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা( রাধা- কৃষ্ণ ও গোপিদের নিত্যলীলা) উদযাপন করে, যা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। প্রতিবছর কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় মাসব্যাপি রাসমেলা অনুষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তী পূর্ণিমা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। যা রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলা উদযাপন করে। এ সময় হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হয়, লোকসঙ্গীত, নাটক, যাত্রাপালা,মেলা এবং পূজা- অর্চনা চলে। 

বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারত, নেপাল থেকে লক্ষাধিক ভক্ত-পুণ্যার্থী ও পর্যটক আসেন। মন্দির এলাকা ভক্তদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে।প্রাচীনকাল থেকে এটি বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় তীর্থ উৎসব।এছাড়া জন্মাষ্টমী, দোলযাত্রা ইত্যাদি উৎসবে মন্দির প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। রাসমেলা উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সংস্কৃতি উৎসব গুলোর মধ্যে একটি। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে এটি সংরক্ষিত এবং অনেকে এটিকে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের যোগ্য মনে করেন।

পর্যটন ও ভ্রমণ তথ্য

কান্তজির মন্দির বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থান। প্রতিবছর হাজারো দেশে-বিদেশি পর্যটক এখানে আসেন। দিনাজপুর শহর থেকে অটো রিক্সা বা ইজিবাইকে ৩০-৪০ মিনিটে পৌঁছানো যায়। প্রবেশ ফি নামমাত্র (বাংলাদেশীদের জন্য ২০- ৫০ টাকা, বিদেশীদের জন্য বেশি)। মন্দির প্রাঙ্গণ শান্ত সবুজে ঘেরা, ঢেপা নদী তীরে হাঁটতে খুবই মনোরম। কাছাকাছি অন্যান্য আকর্ষণ-রামসাগর দীঘি, নয়াবাদ মসজিদ,সুখসাগর এবংদিনাজপুর রাজবাড়ি। এগুলো একদিনের ট্রিপে ঘুরে দেখা যায়। 

থাকার জন্য দিনাজপুর শহরে পর্যটন হোটেল বা অন্য হোটেল আছে।কান্তজির মন্দিরে টেরাকোটা অলংকরণে কোন কামোত্তেজক দৃশ্য নেই (যা দক্ষিণ ভারত বা উড়িষ্যার মন্দিরে অসাধারণ) যা এটিকে আরো অনন্য করে তুলে। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের টেরাকোটা শিল্পের সর্বোচ্চ নিদর্শনগুলোর একটি বলে বিবেচিত ।

 শিল্পী ও কারিগরদের ভূমিকা

কান্তজির মন্দিরের অপূর্ব টেরাকোটা অলংকরণের পেছনে শিল্পী ও কারিগরদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যদিও তাদের নাম ইতিহাসে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখিত নয়। ১৮ শতাব্দীর এই মন্দির নির্মাণে শত শত কারিগরের পরিশ্রম ও সৃজনশীলতা মিশে আছে, যা এটিকে বাংলার টেরাকোটা শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শনে পরিণত করেছে।মন্দিরের অপূর্ব টেরাকোটা অলংকরণের জন্য শিল্পীদের মূলত কৃষ্ণনগর(পশ্চিমবঙ্গ) থেকে আনা হয়েছিল।

 কৃষ্ণনগর তৎকালীন বাংলা টেরাকোটা ও মৃত শিল্পের প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই শিল্পচর্চা হতো। এই শিল্পীরা তাদের স্থানীয় পরিবেশ ও শৈলীর প্রভাব ফুটিয়ে তুলেছে ফলকে যেমন-দেবতাদের চিত্রনে সাধারণ মানুষের মতো বাস্তবতা যোগ করা। কিছু ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখ আছে যে, প্রাণনাথ রাজা পারস্য থেকেও নির্মাণ শিল্পি আনিয়েছিলেন। বিশেষ করে মন্দিরের সৌন্দর্য বর্ধন ও স্থাপত্য কৌশলের জন্য। এতে ইন্দো-পারস্য শৈলীর প্রভাব দেখা যায়।

( যেমন খিলান, গম্বুজের নকশা)। মন্দিরের দক্ষিণে নয়াবাদ গ্রামে এই শিল্পী ও শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জমি দান করা হয়েছিল, যা আজও "মিস্ত্রীপাড়া" নামে পরিচিত। তারা স্থানীয় এঁটেল মাটি দিয়ে ফলক গড়ে, খোদাই করে আগুনে পোড়াতেন। দেবতাদেরও তারা সাধারন মানুষের মতো জীবন্ত করে তুলেছেন, যা তাদের পরিবেশের প্রতিফলন। দুর্ভাগ্যবশত, তৎকালীন রীতি অনুসারে এই শিল্পী কারিগরদের নাম কোথাও লিপিবদ্ধ করা হয়নি( তাজমহলের মত ব্যতিক্রম ছাড়া)।

 তবুও তাদের সৃষ্টি আজও কান্তজির মন্দিরকে জীবন্ত করে রেখেছে। এটি বাংলার লোক শিল্পের অমর স্বাক্ষ্য। যদি সরাসরি দেখেন, তাহলে এই অজানা শিল্পীদের প্রতিভা আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন। এই লোকশিল্পীরা হাজার হাজার ফলক তৈরি করেছেন, যা মন্দিরের সৌন্দর্যের মূল কারন।

শেষ কথাঃ

কান্তজির মন্দির (কান্তজিউ মন্দির) বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অমূল্য রত্ন এবং ভারতীয় উপমহাদেশের টেরাকোটা স্থাপত্যশিল্পের সর্বোচ্চ শিখর।১৮শ শতাব্দীর মাঝামাঝি দিনাজপুরের রাজবংশের ভক্তি, শিল্পপ্রীতি ও অর্থবৃত্তের সংমিশ্রণে জন্ম নেয়া এই মন্দির শুধু একটি ধর্মীয় স্থান নয়, বরং একটি জীবন্ত ঐতিহাসিক দলিল। 

এর দেয়ালে খোদাই করা হাজার হাজার পোড়ামাটির ফলকে পৌরাণিক কাহিনীর পাশাপাশি তৎকালীন বাংলার সমাজজীবন, অভিজাত শ্রেণীর বিলাসিতা, মুঘল প্রভাব এবং দৈনন্দিন জীবনের ছবি এতটাই জীবন্ত যে, এটি আজও আমাদের অতীতের একটি স্পষ্ট আয়না হয়ে আছে।.১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পের নবরত্ন চূড়াগুলো হারিয়ে গেলেও মন্দিরের মূল কাঠামো এবং টেরাকোটা অলংকরণ আজও অক্ষত রয়েছে, যা বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়মিত সংরক্ষণের ফল।

 প্রতিবছর রাস পূর্ণিমা লক্ষাধিক ভক্তের সমাগমে রাসমেলা এই স্থানকে একটি জীবন্ত সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত করে, যেখানে ধর্ম, শিল্প, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতি একসাথে মিলিত হয়। কান্তজির মন্দির আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, বাংলার মাটিতে একদিন এমন শিল্প সমৃদ্ধ ও সহিংসতা ছিল যা ধর্মীয় সীমা অতিক্রম করে সকলকে একত্রিত করত। এটি শুধু হিন্দুর সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় গর্ব এবং বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি সম্ভাব্য প্রার্থী।

 আজকের দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে এই মন্দির দাঁড়িয়ে আছে এক নীরব সাক্ষী হয়ে-আমাদের শেকড়ের,আমাদের শিল্পের, আমাদের ঐতিহ্যের। যতদিন এই টেরাকোটা ফলগুলো সূর্যের আলোয় ঝকঝক করবে এবং রাসমেলার কীর্তন ধবনি এর প্রাঙ্গনে গুঞ্জরিত হবে, ততদিন বাংলার এই অপরূপ সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক সম্পদ জীবিত থাকবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কান্তজির মন্দির শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি বাংলার আত্মার একটি প্রতিচ্ছবি।

 


এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url